Home

ফরিদপুর জিলা স্কুল বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় অবস্থিত একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৮৪০ সালে ইংলিশ সেমিনারি স্কুল হিসাবে যাত্রা শুরু হলেও পরে ১৮৫১ সালে এটি জাতীয়করণ হয়। ব্রিটিশ ভারতের সূচনাকালে যে কয়টি বিদ্যালয় আধুনিক শিক্ষার আলো জ্বালিয়েছিল, ফরিদপুর জিলা স্কুল ছিল তদের অন্যতম। নদীমাতৃক ফরিদপুরের বুকে শিক্ষা, প্রগতিশীল চিন্তা এবং আধুনিকতার বীজ বপন করে এই বিদ্যালয় শতকের পর শতক ধরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে, পাকিস্তান আমলে ভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ – প্রতিটি ধাপে এই বিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভুমিকা গৌরবজ্বল। প্রায় দুইশত বছরের দীর্ঘ যাত্রাপথে এই বিদ্যালয় শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের মাঝে আলো ছড়ায় নি বরং একটি অঞ্চল, সেখানের সমাজ এবং সার্বিকভাবে দেশের শিক্ষাগত বিকাশ আর সাংস্কৃতিক উন্নতির চলমান ইতিহাস হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে।

ইতিহাস

১৭৫৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের আমাদের এই বাংলা অংশের স্বাধীন সত্ত্বা হারানোর মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া নামক যে ব্যবসায়ি কোম্পানিটি পরবর্তীতে উপমহাদেশের শাসন ব্যবস্থার খবরদারিত্ব নিয়ে ফেলে তাদের যে কোন মূল্যে ব্যবসা বা মুনাফা (সোজা কথায় সম্পদ হাতানো) ভিন্ন অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না। ১৮১৩ সালের শিক্ষানীতির আগে এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ইংরেজদের তেমন কোন চিন্তা দেখা যায় না। সেই সময় কোম্পানীর সনদ নবায়নের সময় শর্ত থাকে যে বছরে সব খরচ মিটিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশবাসীর শিক্ষার জন্য এক লক্ষ টাকা খরচ করবে। এই অর্থ অপ্রতুল হলেও এই ব্যাপারটি পরবর্তীতে বিভিন্ন স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় বেশ কিছু স্কুল বিভিন্ন জেলায় স্থাপিত হয় যা পরবর্তীতে জেলা স্কুল হিসাবে স্বীকৃতি পায়। এর মাঝে ১৮২৯ সালে বরিশাল জেলা স্কুল এই অঞ্চলের প্রাচীনতম নিদর্শন। ১৮৩৪ সালে লর্ড বেন্টিংক এর সময়ে ম্যাকলে শিক্ষা নীতির  মাধ্যমে এ দেশে ইংরেজি শিক্ষার জোরালো ভূমিকা শুরু হয়। ১৮৩৭ সালে লর্ড অকল্যান্ড ফারসির পরিবর্তে ইংরেজিকে সরকারি দপ্তরের ভাষা হিসাবে ঘোষনা করেন। এর তিন বছর পর ১৮৪০ সালে ফরিদপুরের তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্টিট এডগার এফ লুথার ও কিছু সম্ভ্রান্ত বিত্তশালীর উদ্যোগে ইংলিশ সেমিনারি স্কুল হিসাবে এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা পায়।

সেই সময় এই অঞ্চলে মুসলমানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে মক্তব ও মাদ্রাসা এবং হিন্দুদের জন্য ছিল পাঠশালা। এই দুই ধরণের প্রতিষ্ঠান ছিল ধর্মীয় ও সামাজিক গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ—আধুনিক বিজ্ঞান, ইউরোপীয় ইতিহাস বা ভূগোলের মতো বিষয় এসব প্রতিষ্ঠানে পড়ানো হতো না। ইংরেজরা মিশনারিরা পশ্চিমা শিক্ষার মাধ্যমে “সভ্যতা” আনতে চেয়েছিল! তারা স্থানীয় জনগনের উপর তাদের প্রভাব বিস্তারের নীতিতে সেই সময় সেমিনারি ধরনের স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় যার ফলশ্রুতিতেই বিভিন্ন জেলায় এই রকম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়।

১৮৪৩ সালে লর্ড ম্যাকলে শিক্ষা বিষয়ে তার Downward Filtration Theory বা নিম্নগামী পরিস্রবণ নীতির কথা বলেন যার মূল কথা ছিল সমাজের উঁচু স্তরের লোকদের শিক্ষিত করে তা নিম্ন শ্রেণীর লোকদের মধ্যে নামিয়ে দেয়া। শিক্ষাক্ষেত্রে এই নীতি কোনভাবেই কার্যকরী হয় নি বিশেষ করে তখন হিন্দুদের মধ্যে প্রবল জাতিভেদ থাকাতে তা শ্রেণী বিভক্তি আরও বাড়িয়ে দেয়। এ নীতির ফলে মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক লোক পাশ্চাত্য শিক্ষার সুযোগ লাভ করলেন বটে, কিন্তু সে শিক্ষা সুবিধাভোগকারী ঐ শ্রেণীর লোকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইলো। শিক্ষা পরিশ্রুত হয়ে সাধারণ মানুষের নিকট পৌঁছার সুযোগ পায়নি। একই সঙ্গে এই নীতি শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করে যাতে জাতীয় সংহতির পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি শাসকগোষ্ঠীর বিমাতাসূলভ আচরণের ফলে দেশের জনশিক্ষার ক্ষেত্রে এক বিরাট শুণ্যতা ও ব্যবধান সৃষ্টি হয়। এ নীতি অনুসরণের ফলশ্রুতি হিসেবে লক্ষ্য করা যায় ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে দেশে শিক্ষিতের হার যা ছিল পরবর্তী পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে সরকারী নীতি গ্রহণ করা সত্ত্বেও বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে নিরক্ষরতার হার আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে এই নীতি গৃহীত হওয়ার পর সরকারী প্রচেষ্টায় জেলা সদরে একটি করে উচ্চ ইংরেজী স্কুল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই সুযোগেই আমাদের সেই ইংলিশ স্কুলটি ব্রিটিশ সরকারের অর্থানুকূল্য ও স্বীকৃতি অর্জন করে ১৯৫১ সালে ফরিদপুর জিলা স্কুল নাম নিয়ে। এ সময় সারা দেশেই ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক ব্যক্তি স্কুল প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষকতার কাজে এগিয়ে আসতে থাকেন। তাঁদেরই ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ দেশে শিক্ষার বিস্তার ঘটে।

গৌরবের ১৮৫ বছর এবং পুনর্মিলনী ২০২৫

দীর্ঘ সময়ের পথে আমাদের স্কুল শুধু শিক্ষা প্রদান করেনি, বরং সমাজে আলোকিত মানুষ গড়ে তুলেছে। যখন দেশে শিক্ষার ধারণাটিই সুস্পষ্ট হয়নি, তখন সমাজের উঁচু শ্রেণির সন্তানদের জন্য এই প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। কিন্তু সময়ের প্রবাহে, এই বিদ্যালয় হয়ে উঠেছে জনগণের স্কুল – সবার জন্য শিক্ষা, সবার জন্য আলোর দিশা। এই স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন বা এসএসসি পাশ করে সমাজের বিভিন্ন স্তরে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুনামের সঙ্গে কাজ করে চলেছেন এই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্ররা। এই প্রাক্তণ ছাত্র বা এলামনাইরা হচ্ছেন স্কুলের সবচেয়ে বড় এম্বাসাডর বা প্রতিনিধি। স্কুলের সুদীর্ঘ ১৮৫ বছরের ইতিহাসে এইসব প্রাক্তন ছাত্রদের মিলনমেলা বা পুনর্মিলনী খুব বেশি হয় নি।

যতদূর জানা যায় ১৯৮০ সালের পূনর্মিলনীর পর এই বছর ২০২৫ সালের শেষ অংশে আবার একটি পূনর্মিলনীর আয়োজন হতে যাচ্ছে। এই পুনর্মিলনী শুধুমাত্র একটি উৎসব নয় – এটি এক ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ, একটি ইতিহাসের পুনঃস্মরণ এবং এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে অনুপ্রেরণার হস্তান্তর। স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের প্রত্যেকে এই আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হোক, পুনর্মিলনীর সার্বিক সাফল্য আমাদের কাম্য।